তারা স্বেচ্ছায় নিজেদের বিলিয়ে দিয়েছেন—তুরস্কে
প্রথম শতাব্দীর খ্রিস্টানরা যথাসম্ভব সবচেয়ে বেশি লোকের কাছে ‘রাজ্যের সুসমাচার’ জানানোর জন্য অনেক প্রচেষ্টা করেছিল। (মথি ২৪:১৪) কেউ কেউ এমনকী বিদেশে ভ্রমণ করেছিল। উদাহরণ স্বরূপ, প্রেরিত পৌল এমন এক এলাকায় গিয়েছিলেন, যেখানে বর্তমান সময়ে তুরস্ক অবস্থিত আর তিনি তার মিশনারি যাত্রাগুলোর সময় সেখানে ব্যাপক আকারে প্রচার করেছিলেন। a প্রায় ২,০০০ বছর পর, ২০১৪ সালে তুরস্কে আবারও এক বিশেষ প্রচার অভিযানের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কেন এই অভিযানের ব্যবস্থা করা হয়েছিল? কারা এতে অংশ নিয়েছিল?
“এখানে কী হচ্ছে?”
তুরস্কে ২,৮০০-রও বেশি প্রকাশক রয়েছে কিন্তু এই দেশে প্রায় ৮ কোটি লোক বাস করে। এর অর্থ, জনসংখ্যার সঙ্গে প্রকাশকদের অনুপাত হল প্রতি ২৮,০০০ জনের মধ্যে ১ জন। আপনারা যেমনটা কল্পনা করতে পারছেন, প্রকাশকরা এই দেশের কেবল অল্পসংখ্যক অধিবাসীর কাছেই সুসমাচার সম্বন্ধে জানাতে পেরেছে। সেই বিশেষ প্রচার অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল অল্প সময়ের মধ্যে যথাসম্ভব সবচেয়ে বেশি লোকের কাছে সুসমাচার জানানো। প্রায় ৫৫০ জন তুর্কিভাষী ভাই ও বোন অন্যান্য দেশ থেকে তুরস্কে এসেছিল এবং স্থানীয় প্রকাশকদের সঙ্গে অভিযানে অংশ নিয়েছিল। এর ফল কী হয়েছিল?
ব্যাপক আকারে সাক্ষ্যদান করা হয়েছিল। ইস্তানবুলের একটা মণ্ডলী চিঠি লিখে জানিয়েছিল: “লোকেরা আমাদের দেখে জিজ্ঞেস করেছিল: ‘এখানে কি কোনো বিশেষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে? সব জায়গায় যিহোবার সাক্ষিদের দেখা যাচ্ছে!’” ইজমির শহরের একটা মণ্ডলী চিঠি লিখে জানিয়েছিল: “ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে কাজ করেন এমন একজন ব্যক্তি এক স্থানীয় প্রাচীনের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘এখানে কী হচ্ছে? দেখে মনে হচ্ছে, আপনারা আগের চেয়ে অনেক বেশি কাজ করছেন!’” হ্যাঁ, লোকেরা সেই অভিযান লক্ষ করেছিল।
বিদেশ থেকে আসা যোগদানকারী ভাই-বোনেরা সেই প্রচার কাজে অংশ নিতে পেরে খুব আনন্দিত হয়েছিল। স্টেফান নামে একজন ভাই, যিনি ডেনমার্ক থেকে এসেছিলেন, বলেন: “প্রতিদিন আমি এমন ব্যক্তিদের কাছে প্রচার করতে পেরেছিলাম, যারা আগে কখনো যিহোবার বিষয়ে শোনেনি। আমার মনে হয়েছিল যেন আমি সত্যিই যিহোবার নাম জানানোর কাজ করতে পেরেছিলাম।” জা-ডাভিড নামে একজন ভাই, যিনি ফ্রান্স থেকে এসেছিলেন, লেখেন: “আমরা কেবল একটা রাস্তাতেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা প্রচার করেছিলাম। এটা সত্যিই দারুণ ছিল! বেশিরভাগ লোকই যিহোবার সাক্ষিদের সম্বন্ধে জানত না। প্রায় প্রতিটা বাড়িতে আমরা কথাবার্তা শুরু করতে, আমাদের কোনো ভিডিও দেখাতে এবং গৃহকর্তার কাছে সাহিত্য অর্পণ করতে পেরেছিলাম।”
সেই ৫৫০ জন অংশগ্রহণকারী মাত্র দু-সপ্তাহে প্রায় ৬০,০০০ কপি সাহিত্য অর্পণ করেছিল। এই অভিযানের ফলে সত্যিই এক ব্যাপক আকারে সাক্ষ্যদান করা হয়েছিল।
পরিচর্যার প্রতি উদ্যোগ বৃদ্ধি পেয়েছিল। এই বিশেষ অভিযান স্থানীয় ভাই-বোনদের প্রচুররূপে অনুপ্রাণিত করেছিল। অনেকে পূর্ণসময়ের সেবা শুরু করার বিষয়ে চিন্তা করতে শুরু করেছিল। সত্যি বলতে কী, অভিযানের পরবর্তী ১২ মাসের মধ্যে তুরস্কে নিয়মিত অগ্রগামীদের সংখ্যা ২৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল।
বিদেশ থেকে আসা অংশগ্রহণকারীরা প্রকাশ করেছিল যে, কীভাবে এই অভিযান এমনকী নিজেদের দেশে ফিরে যাওয়ার পরও তাদের পরিচর্যাকে প্রভাবিত করেছে। শিরান নামে একজন বোন, যিনি জার্মানি থেকে এসেছিলেন, লেখেন: “তুরস্কের ভাই-বোনেরা খুব সহজেই রীতিবহির্ভূতভাবে সাক্ষ্যদান করে। রীতিবহির্ভূতভাবে সাক্ষ্যদান করার সময় আমার খুব লজ্জা লাগত। কিন্তু, এই বিশেষ অভিযান, স্থানীয় ভাইদের উদাহরণ এবং অনেক প্রার্থনার ফলে আমি এমন কিছু করতে পেরেছিলাম, যেটা আমি আগে করতে পারতাম না। আমি এমনকী সাবওয়েতে প্রচার করেছিলাম এবং বিভিন্ন ট্র্যাক্ট অর্পণ করেছিলাম! এখন আমি আর আগের মতো লাজুক নই।”
ইয়োহানাস নামে একজন ভাই, যিনি জার্মানি থেকে এসেছিলেন, বলেন: ‘আমি আমার ব্যক্তিগত পরিচর্যা সম্বন্ধে কিছু বিষয় শিখেছিলাম। তুরস্কের ভাই-বোনেরা সত্যিই যথাসম্ভব সবচেয়ে বেশি লোকের কাছে সত্য সম্বন্ধে জানাতে চায়। তারা প্রতিটা সুযোগে সাক্ষ্যদান করে। আমি জার্মানিতে ফিরে গিয়ে একই বিষয় করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আর এখন আমি সত্যিই আগের চেয়ে বেশি লোকের কাছে প্রচার করি।’
জেনেপ নামে একজন বোন, যিনি ফ্রান্স থেকে এসেছিলেন, বলেন: “এই অভিযান আমার ব্যক্তিগত পরিচর্যাকে প্রচুররূপে প্রভাবিত করেছে। এটা আমাকে আরও বেশি সাহসী হতে এবং যিহোবার উপর আরও বেশি আস্থা রাখতে সাহায্য করেছে।”
প্রকাশকরা একে অন্যের আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। বিভিন্ন দেশ থেকে আসা ভাই-বোনদের প্রেম ও একতা এক দীর্ঘস্থায়ী ছাপ ফেলেছিল। আগে উল্লেখিত ভাই জা-ডাভিড বলেন, “আমরা ভাই-বোনদের আতিথেয়তা ‘আস্বাদন’ করেছিলাম।” তিনি আরও বলেন: “তারা আমাদের তাদের বন্ধু হিসেবে এবং তাদের পরিবারের অংশ হিসেবে গ্রহণ করেছিল। তারা আমাদের তাদের বাড়িতে থাকতে দিয়েছিল। আমি জানতাম যে, আমাদের এক আন্তর্জাতিক ভ্রাতৃসমাজ রয়েছে; এই বিষয়টা আমি আমাদের সাহিত্যে বহু বার পড়েছি। কিন্তু, এই প্রথম বার আমি নিজে এটা অনুভব করেছিলাম। আমি এই বিষয়ে আরও বেশি গর্ব অনুভব করেছিলাম যে, আমি যিহোবার লোকেদের মধ্যে একজন আর এই চমৎকার সুযোগের জন্য আমি তাঁর কাছে খুবই কৃতজ্ঞ।”
ক্লার নামে একজন বোন, যিনি ফ্রান্স থেকে এসেছিলেন, বলেন: “আমরা ডেনমার্ক, ফ্রান্স, জার্মানি অথবা তুরস্ক, যেখানকারই
অধিবাসী হই না কেন, আমরা সকলেই একটা পরিবারের অংশ। এটা এমন যেন যিহোবা একটা বড়ো রাবার দিয়ে সমস্ত জাতিগত সীমানা মুছে দিয়েছেন।”স্টেফানি নামে একজন বোন, যিনি ফ্রান্স থেকে এসেছিলেন, আরও বলেন: “এই বিশেষ অভিযান আমাদের এটা শিখতে সাহায্য করেছিল যে, সংস্কৃতি কিংবা ভাষা নয় বরং যিহোবার প্রতি আমাদের সকলের ভালোবাসাই আমাদের একতাবদ্ধ করে।”
দীর্ঘস্থায়ী উপকার লাভ করা গিয়েছে
বিদেশ থেকে আসা অনেক অংশগ্রহণকারী তাদের নিজেদের দেশে ফিরে যাওয়ার পর, তুরস্কে যে-প্রচুর কাজ বাকি রয়েছে, তাতে সাহায্য করার জন্য সেখানে ফিরে গিয়ে দীর্ঘসময় ধরে সেবা করার বিষয়ে চিন্তা করতে শুরু করেছিল। বেশ কয়েক জন ভাই-বোন ইতিমধ্যে তুরস্কে চলে এসেছে। এই ভাই-বোনেরা যেখানে বেশি প্রয়োজন, সেখানে গিয়ে সেবা করছে আর তাদের এই কাজকে খুবই মূল্যবান বলে মনে করা হয়।
উদাহরণ স্বরূপ, তুরস্কের একটা ছোটো বিচ্ছিন্ন দলের কথা বিবেচনা করুন, যেখানে ২৫ জন প্রকাশক রয়েছে। অনেক বছর ধরে সেই দলে কেবল একজন প্রাচীন ছিলেন। ২০১৫ সালে যখন জার্মানি ও নেদারল্যান্ডস থেকে ছ-জন প্রকাশক যেখানে বেশি প্রয়োজন, সেখানে সেবা করার জন্য সেই এলাকায় গিয়েছিলেন, তখন সেই দলের ভাই-বোনেরা কতটা আনন্দিত হয়েছিল, তা একটু কল্পনা করুন!
যেখানে বেশি প্রয়োজন, সেখানে গিয়ে সেবা করা
যেখানে বেশি প্রয়োজন, সেখানে গিয়ে সেবা করার জন্য যে-প্রকাশকরা কিছু সময়ের জন্য তুরস্কে রয়েছে, তারা সেখানে জীবনযাপন করার বিষয় কী বলে? এটা ঠিক যে, কখনো কখনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা আসে কিন্তু যেখানে বেশি প্রয়োজন, সেখানে গিয়ে সেবা করা প্রচুর আশীর্বাদ নিয়ে আসে। কয়েক জন ভাই-বোনের মন্তব্য বিবেচনা করুন:
ফেডেরিকো নামে স্পেন থেকে আসা একজন বিবাহিত ভাই, যার বয়স ৪০-এর কোঠার প্রথম দিকে, বলেন: “যেহেতু আমার প্রচুর বস্তুগত সম্পত্তি নেই, তাই আমি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারি আর এটা আমাকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর উপর মনোযোগ বজায় রাখতে সাহায্য করেছে।” তিনি কি অন্যদের এই ধরনের সেবা করার জন্য সুপারিশ করবেন? তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, অবশ্যই! আপনি যখন অন্যদের যিহোবা সম্বন্ধে জানতে সাহায্য করার জন্য বিদেশে চলে যান, তখন আপনি আসলে নিজেকে তাঁর যত্নের অধীনে সমর্পণ করেন। তারপর, আপনি সত্যি সত্যিই আগের চেয়ে আরও বেশি করে যিহোবার যত্ন অনুভব করেন।’
রুডি নামে নেদারল্যান্ডস থেকে আসা একজন বিবাহিত ভাই, যার বয়স ৫০-এর কোঠার শেষের দিকে, বলেন: ‘যেখানে বেশি প্রয়োজন,
সেখানে গিয়ে সেবা করা এবং আগে কখনো সত্যের বিষয়ে শোনেনি, এমন অসংখ্য লোকের কাছে সত্য জানানো প্রচুর পরিতৃপ্তি এনে দেয়। লোকেরা যখন সত্য গ্রহণ করে, তখন তারা যে-আনন্দ লাভ করে, সেটা দেখা সত্যিই আমাদের অনেক খুশি করে।’সাশা নামে জার্মানি থেকে আসা একজন বিবাহিত ভাই, যার বয়স ৪০-এর কোঠার প্রথম দিকে, বলেন: “প্রতি বার পরিচর্যায় আমার এমন ব্যক্তিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়, যারা এই প্রথম সত্য সম্বন্ধে জানতে পাচ্ছে। এইরকম ব্যক্তিদের যিহোবাকে জানার সুযোগ করে দেওয়ার ফলে আমি প্রচুর পরিতৃপ্তি লাভ করি।”
আটসুকো নামে জাপান থেকে আসা একজন বিবাহিত বোন, যার বয়স ৩০-এর কোঠার মাঝের দিকে, বলেন: “অতীতে আমি সবসময় চাইতাম যেন আরমাগিদোন খুব তাড়াতাড়ি চলে আসে। কিন্তু, তুরস্কে চলে আসার পর আমি যিহোবাকে এই বিষয়ে ধন্যবাদ দিই যে, তিনি এখনও ধৈর্য ধরে রয়েছেন। বিশ্বব্যাপী প্রচার কাজে আমি যত বেশি করে যিহোবাকে নির্দেশনা দিতে দেখি, তত বেশি আমি তাঁর নিকটবর্তী হই।”
আলিসা নামে রাশিয়া থেকে আসা একজন বোন, যার বয়স ৩০-এর কোঠার প্রথম দিকে, বলেন: “এই ধরনের পরিচর্যায় অংশ নেওয়ার মাধ্যমে যিহোবাকে সেবা করার ফলে আমি সত্যিই তাঁর সমস্ত মঙ্গলভাব আস্বাদন করে দেখতে পেরেছি।” (গীত. ৩৪:৮) তিনি আরও বলেন: “যিহোবা কেবল আমার পিতা নন কিন্তু সেইসঙ্গে তিনি হলেন আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু, যাঁর সম্বন্ধে আমি বিভিন্ন পরিস্থিতিতে আরও ভালোভাবে জানতে পারি। আমার জীবন আনন্দপূর্ণ মূহুর্তে, আগ্রহজনক অভিজ্ঞতায় এবং প্রচুর আশীর্বাদে পরিপূর্ণ!”
“ক্ষেত্রের প্রতি দৃষ্টিপাত কর”
তুরস্কে এই বিশেষ প্রচার অভিযানের ফলে আরও বেশি লোকের কাছে সুসমাচার সম্বন্ধে জানানো সম্ভবপর হয়েছে। কিন্তু, এখনও এমন অনেক এলাকা রয়েছে, যেখানে প্রচার করা হয়নি। যেখানে বেশি প্রয়োজন, সেখানে গিয়ে সেবা করে এমন ভাই-বোনদের প্রতিদিন তুরস্কে এমন ব্যক্তিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়, যারা কখনো যিহোবার বিষয়ে শোনেনি। আপনি কি এইরকম কোনো এলাকায় সেবা করতে চান? যদি চান, তা হলে আমরা আপনাকে উৎসাহিত করছি: “চক্ষু তুলিয়া ক্ষেত্রের প্রতি দৃষ্টিপাত কর, শস্য এখনই কাটিবার মত শ্বেতবর্ণ হইয়াছে।” (যোহন ৪:৩৫) আপনি কি বিশ্বের এমন কোনো অংশে সাহায্য করতে পারেন, যেখানে ক্ষেত্রের শস্য “কাটিবার মত শ্বেতবর্ণ” হয়ে আছে? যদি পারেন, তা হলে সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য এখনই ব্যাবহারিক পদক্ষেপ নিতে শুরু করুন। একটা বিষয় নিশ্চিত: “পৃথিবীর প্রান্ত পর্য্যন্ত” সুসমাচার ছড়িয়ে দেওয়ার কাজে আরও বেশি করে অংশ নেওয়ার মাধ্যমে আপনি এমন অনেক আশীর্বাদ লাভ করবেন, যেগুলোর সঙ্গে কোনো কিছুর তুলনা করা যায় না!—প্রেরিত ১:৮.